বরিশাল, বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় একটি সমৃদ্ধ জেলা, যা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য পরিচিত। বরিশালের খাবারেও রয়েছে বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য, যা স্থানীয়দের পাশাপাশি পর্যটকদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। বরিশালের খাবারগুলি ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ এবং রন্ধনশৈলীর কারণে ভোজনরসিকদের কাছে বিশেষ আকর্ষণীয়। এখানে বরিশালের বিখ্যাত খাবারগুলির তালিকা এবং বর্ণনা তুলে ধরা হলো।
১. ইলিশ মাছ
বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় ইলিশ জনপ্রিয় হলেও বরিশালের ইলিশ মাছের স্বাদ অতুলনীয়। বিশেষত পায়রা নদী এবং কীর্তনখোলা নদীর ইলিশ খুব সুস্বাদু। বরিশালের ইলিশ মাছ বিভিন্নভাবে রান্না করা হয়, যার মধ্যে সরিষার তেল দিয়ে ইলিশ ভাজা, ইলিশ পাতুরি, ইলিশের মাথা দিয়ে শাক রান্না, ও ভাপা ইলিশ অন্যতম। বরিশালের ইলিশের স্বাদ এবং ঘ্রাণ একেবারে আলাদা, যা এই অঞ্চলের পানির কারণে হয়ে থাকে বলে মনে করা হয়।
২. মোরগ পোলাও
বরিশালের বিয়ে এবং সামাজিক অনুষ্ঠানে মোরগ পোলাও একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় খাবার। এটি খাসি বা মুরগির মাংসের সাথে সুগন্ধি চাল ও মশলা দিয়ে রান্না করা হয়। বরিশালের মোরগ পোলাওয় খুব কম মশলা ব্যবহার করা হয়, যাতে খাবারটি হালকা এবং সুস্বাদু হয়। ধনেপাতা, কাঁচা মরিচ, ও লেবুর রস দিয়ে সাজানো এই মোরগ পোলাও স্থানীয়দের পছন্দের একটি খাবার।
৩. চিড়া ও নারিকেল
বরিশালে চিড়া বা পিঠে খাওয়ার সময়ে নারিকেল, দুধ, ও গুড় দিয়ে পরিবেশন করা হয়। বিশেষ করে শীতে এই খাবারটি খুবই জনপ্রিয়। সকালে বা বিকেলে হালকা নাস্তায় এই খাবার বরিশালের বাড়িতে প্রচলিত। চিড়া এবং নারিকেলের এই মিশ্রণ অত্যন্ত পুষ্টিকর ও সহজে হজমযোগ্য। গুড়ের মিষ্টত্ব এবং নারিকেলের মোলায়েম স্বাদ খাবারটিকে অতুলনীয় করে তোলে।
৪. সাদা ভাত ও মাছের ঝোল
বরিশালের রসুইঘরের আরেকটি জনপ্রিয় খাবার হচ্ছে সাদা ভাত ও মাছের ঝোল। বরিশালের নদী ও পুকুরে পাওয়া তাজা মাছের সাথে হালকা মশলা ও সবজি দিয়ে মাছের ঝোল রান্না করা হয়। মাছের মধ্যে রুই, কাতলা, টাকি, বা পুঁটি ব্যবহার করা হয়। এই খাবারটি খুবই হালকা এবং স্বাস্থ্যকর।
৫. দই চিড়া
বরিশালের ঐতিহ্যবাহী খাবারের মধ্যে দই চিড়া উল্লেখযোগ্য। বিশেষ করে বৈশাখী উৎসব বা পহেলা বৈশাখে এটি অত্যন্ত জনপ্রিয়। ঘন দই, মিষ্টি চিড়া এবং সামান্য চিনি বা গুড় দিয়ে এই খাবার পরিবেশন করা হয়। পহেলা বৈশাখে বরিশালের ঘরে ঘরে দই চিড়া খাওয়া হয় এবং অতিথিদেরও এটি আপ্যায়ন করা হয়।
৬. বাউফলের মিষ্টি
বরিশালের বাউফল উপজেলা মিষ্টির জন্য বিখ্যাত। এখানে পাওয়া যায় নানা ধরনের মিষ্টি, যার মধ্যে মিষ্টির দই, রসগোল্লা, সন্দেশ অন্যতম। বাউফলের মিষ্টিগুলি দেশজুড়ে জনপ্রিয় এবং বিশেষ করে উৎসব ও বিয়েতে এ মিষ্টি পরিবেশন করা হয়। এখানকার মিষ্টি বানাতে ব্যবহার করা হয় খাঁটি দুধ ও মিষ্টির রস, যা খাবারে অনন্য স্বাদ যুক্ত করে।
৭. চিতই পিঠা ও ভর্তা
বরিশালে শীতের মৌসুমে চিতই পিঠা বানানো হয়। চিতই পিঠা খেজুরের গুড় দিয়ে অথবা বিভিন্ন ভর্তার সাথে খাওয়া হয়। বরিশালের পল্লী অঞ্চলে চিতই পিঠার সাথে বেগুন, আলু, শাক, কাঁচা মরিচ, এবং টমেটো ভর্তা পরিবেশন করা হয়। এই ভর্তার অনন্য স্বাদ এবং চিতই পিঠার নরম গঠন ভোজনরসিকদের মুগ্ধ করে।
৮. নারকেলের নাড়ু
নারকেলের নাড়ু বরিশালে অন্যতম জনপ্রিয় মিষ্টান্ন। এটি বিভিন্ন উৎসব ও অনুষ্ঠানে তৈরি করা হয়। নারকেল কুরানো এবং গুড় বা চিনি দিয়ে তৈরি করা এই নাড়ু অত্যন্ত সুস্বাদু। এটি সহজে সংরক্ষণযোগ্য হওয়ায় অনেক দিন পর্যন্ত খাওয়া যায়। শীতকালে বিশেষ করে পিঠা-পুলি ও নাড়ুর প্রচলন বেশ বেশি থাকে বরিশালে।
৯. কুমড়ো বড়ি
বরিশালের আরও একটি পরিচিত খাবার হচ্ছে কুমড়ো বড়ি। এটি বিশেষ করে শীতে বানানো হয়। কুমড়ো ও ডাল দিয়ে তৈরি এই বড়ি ভর্তা বা তরকারিতে মিশিয়ে খাওয়া হয়। কুমড়ো বড়ি শুকিয়ে রেখে পরে তরকারির সাথে রান্না করা হয়, যা খাবারে ভিন্ন স্বাদ যোগ করে।
১০. শুঁটকি মাছের ভর্তা
বরিশালে শুঁটকি মাছের ভর্তা খুব জনপ্রিয় একটি খাবার। এই ভর্তা তৈরিতে শুকনা শুঁটকি মাছ, পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ, সরিষার তেল এবং ধনেপাতা ব্যবহার করা হয়। বরিশালের বাড়িতে শুঁটকি ভর্তা ভাতের সাথে খাওয়া হয়।
১১. আমসত্ত্ব
বরিশালের আমসত্ত্ব সারা দেশজুড়ে বিখ্যাত। স্থানীয়ভাবে উৎপন্ন আম দিয়ে তৈরি এই আমসত্ত্ব খুবই মিষ্টি ও সুস্বাদু। বরিশালের আমসত্ত্ব বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপহার হিসেবেও দেওয়া হয়। আমের রস ও চিনির মিশ্রণ ঘন করে শুকিয়ে আমসত্ত্ব তৈরি করা হয়।
১২. চালের পায়েস
বরিশালে চালের পায়েস অত্যন্ত জনপ্রিয় মিষ্টি, যা খাঁটি দুধ, চাল, চিনি বা গুড় দিয়ে তৈরি করা হয়। এটি সাধারণত বিয়ে, জন্মদিন বা অন্যান্য বিশেষ উপলক্ষে তৈরি করা হয়। পায়েসে কিশমিশ, কাজু বাদাম এবং এলাচ ব্যবহার করা হয়, যা মিষ্টান্নটিতে অতিরিক্ত স্বাদ যোগ করে।
১৩. বেতাগী হাটের গুড়
বরিশালের বেতাগী হাটে বিভিন্ন ধরনের গুড় পাওয়া যায়। বিশেষ করে খেজুরের গুড় এখানকার বিখ্যাত। শীতকালে খেজুরের রস থেকে তৈরি খাঁটি গুড় বরিশালের এক বিশেষ খাদ্য, যা বিভিন্ন ধরনের পিঠা তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। বরিশালের গুড় খেতে অত্যন্ত সুস্বাদু এবং এটি অনেক দিন ধরে সংরক্ষণযোগ্য।
১৪. মোয়া
মোয়া বরিশালের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি, যা চিড়া বা মুড়ি এবং খেজুরের গুড় দিয়ে তৈরি করা হয়। এটি খুবই জনপ্রিয় এবং বিভিন্ন উৎসবে এটি বিশেষভাবে প্রস্তুত করা হয়। মোয়া খেতে মচমচে এবং মিষ্টি হওয়ায় এটি সবার কাছেই প্রিয়।
বরিশালের এই খাবারগুলির বিশেষত্ব হলো স্বাদে, গন্ধে এবং পরিবেশনে। এসব খাবার স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের পরিচায়ক, যা এই অঞ্চলের ভোজনরসিকদের পাশাপাশি দেশজুড়ে অনেকের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
Leave a Reply