বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ হিসেবে পরিচিত, কারণ এই দেশের ভূখণ্ডজুড়ে অসংখ্য নদী প্রবাহিত হয়েছে। বাংলাদেশের প্রধান নদীসমূহ ভূমি, জলবায়ু, সংস্কৃতি, কৃষি ও অর্থনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলে। এ লেখায় বাংলাদেশের প্রধান নদীসমূহ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
১. পদ্মা নদী
বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান নদী পদ্মা। এটি ভারতের গঙ্গা নদীর প্রধান শাখা, যা বাংলাদেশের প্রবেশ করে ফরিদপুর ও রাজশাহী অঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। এরপর এটি মেঘনা নদীর সাথে মিলিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। পদ্মা নদী মোট প্রায় ৩৬৬ কিলোমিটার দীর্ঘ। নদীটির তীরে বড় বড় শহর গড়ে উঠেছে যেমন রাজশাহী, মাওয়া, এবং মাদারীপুর। পদ্মা নদীর পানি কৃষিকাজ, জেলেদের জন্য মাছ ধরার ক্ষেত্রে এবং দেশটির দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ।
২. যমুনা নদী
যমুনা বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ ও প্রশস্ত নদী। এটি ভারত থেকে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে ব্রহ্মপুত্র নামে প্রবেশ করে এবং যমুনা নাম ধারণ করে। যমুনা নদী উত্তরাঞ্চলের সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল এবং মানিকগঞ্জের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পদ্মা নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। যমুনার দৈর্ঘ্য প্রায় ২৭৬ কিলোমিটার। এই নদীর তীরে বাঁধ ও সেতু নির্মাণ বাংলাদেশের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আরও উন্নত করেছে। যমুনা নদী বন্যা নিয়ন্ত্রণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৩. মেঘনা নদী
মেঘনা বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রশস্ত নদী। এটি সুরমা এবং কুশিয়ারা নদীর মিলিত প্রবাহ হিসেবে সিলেট থেকে শুরু হয় এবং বিভিন্ন নদীর সাথে যুক্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। মেঘনা নদীর মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ২৬০ কিলোমিটার। এই নদীর পানি কৃষি, বাণিজ্য ও পরিবহন ব্যবস্থায় ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে এই নদী মাছ ধরার জন্যও বিখ্যাত।
৪. ব্রহ্মপুত্র নদী
ব্রহ্মপুত্র ভারতের আসাম ও তিব্বত থেকে উৎপত্তি হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে যমুনা নাম ধারণ করেছে। এটি বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ নদী। এই নদীর তীরে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহর গড়ে উঠেছে, যেমন জামালপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম। ব্রহ্মপুত্র নদী অববাহিকায় প্রচুর পলিমাটি সঞ্চিত হয়, যা কৃষির জন্য অত্যন্ত উর্বর। প্রতি বছর বর্ষার সময় এই নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়, যা কৃষকদের জন্য কষ্টসাধ্য হলেও পরে উর্বর জমির জন্য উপকারী।
৫. কর্ণফুলী নদী
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে কর্ণফুলী নদী একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী। এটি চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রবাহিত হয়েছে এবং বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। কর্ণফুলীর ওপর নির্মিত কর্ণফুলী সেতু চট্টগ্রামের বাণিজ্যিক যোগাযোগে অত্যন্ত সহায়ক। এই নদীর তীরে অবস্থিত চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের সবচেয়ে ব্যস্ত ও গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র বন্দর, যা দেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মূল কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া চট্টগ্রামের কর্ণফুলী বিদ্যুৎকেন্দ্রও এই নদীর পানির ওপর নির্ভরশীল।
৬. তিস্তা নদী
তিস্তা নদী বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের রংপুর ও লালমনিরহাট জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে এ নদীটি বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তিস্তার পানি সেচের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই অঞ্চলে চাষাবাদের জন্য পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ করে। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তিস্তার পানির পরিমাণে শুষ্ক মৌসুমে ব্যাপক হ্রাস দেখা গেছে, তবে এই নদী বাংলাদেশের কৃষি ও অর্থনীতিতে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৭. পশুর নদী
পশুর নদী বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলবর্তী খুলনা বিভাগের একটি প্রধান নদী। এটি সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার কারণে সুন্দরবন অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পশুর নদী সুন্দরবনের কাছাকাছি হওয়ায় পরিবেশগত দিক থেকে খুব সংবেদনশীল। খুলনা অঞ্চলের মানুষের জীবিকার জন্য এই নদী মাছ ধরা ও পরিবহন কাজে ব্যবহৃত হয়।
৮. গোমতী নদী
গোমতী নদী বাংলাদেশের কুমিল্লা অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত একটি ছোট নদী হলেও এর গুরুত্ব যথেষ্ট। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে উৎপত্তি হয়ে গোমতী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এই নদীর পানি কৃষি কাজে এবং সেচের কাজে ব্যবহৃত হয়। বর্ষাকালে গোমতী নদীর পানির প্রবাহ বৃদ্ধি পায় এবং এর ফলে কুমিল্লা অঞ্চলে বন্যার পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।
৯. ধলেশ্বরী নদী
ধলেশ্বরী নদী বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে প্রবাহিত এবং দেশের ঐতিহ্যবাহী নদী হিসেবে পরিচিত। এই নদী পদ্মা নদী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ঢাকার কাছ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে শীতলক্ষ্যা নদীর সাথে যুক্ত হয়েছে। এই নদীটি ময়মনসিংহ ও নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলে প্রবাহিত হয়। শিল্প কারখানা গড়ে ওঠার ফলে ধলেশ্বরী নদীর পানি অনেকাংশে দূষিত হয়েছে।
১০. শীতলক্ষ্যা নদী
শীতলক্ষ্যা নদী বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী। এটির উৎপত্তি ধলেশ্বরী নদী থেকে এবং পরে এটি মেঘনা নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ একটি শিল্পাঞ্চল হওয়ায় শীতলক্ষ্যা নদীর পানি দূষণের শিকার হয়েছে।
১১. আড়িয়াল খাঁ নদী
মাদারীপুর, বরিশাল ও শরীয়তপুর জেলায় প্রবাহিত আড়িয়াল খাঁ নদী বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে কৃষিকাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। পদ্মা নদীর শাখা হিসেবে আড়িয়াল খাঁ প্রবাহিত হওয়ায় এ অঞ্চলের সেচ কাজ ও পানি সরবরাহে এর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
উপসংহার
বাংলাদেশের প্রধান নদীসমূহ দেশের পরিবেশ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, ও জীবিকা নির্বাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
Leave a Reply